Boba Meyer Biye | বোবা মেয়ের বিয়ে | Full Drama | Jibon Roy | Twink Carol | Bangla New Natok 2022
গভীর রাতে স্ত্রীর শয্যা থেকে উঠে গুটি গুটি পায়ে মাধবীর কক্ষে চলে গেলেন শফিক আহমেদ। প্রায় একঘন্টার মতো সেখানে সময় কাটিয়ে বের হয়ে চলে আসলেন নিজের কক্ষে। নিজের কক্ষে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই তার স্ত্রী ফারজানা বলে উঠলেন, এতো রাতে মাধবীর কাছে কেনো গিয়েছিলে?
স্ত্রী কথা শুনে চমকে উঠলেন তিনি। তার স্ত্রী যে জাগ্রত ছিলো তিনি সেটা খেয়াল করেন নি। নিজের ভুলের জন্য এখন কী ঘটতে যাচ্ছে, তা ভাবতেই শিউরে উঠলেন তিনি। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, মাধবীর খুব জ্বর, তাই ওকে দেখতে গিয়েছিলাম।
শফিকের কথা শুনে ফারজানা বললেন, এতো রাতে তুমি অসুস্থ একটা মেয়েকে একঘন্টার জন্য দেখতে গিয়েছো, তাই না? মিথ্যা কথা বলার আর জায়গা পাও না? নিজের ভাতিজি তো মেয়েই হয় তাই না? নিজের ভাতিজিকেও তুমি ছাড়লে না?
ফারজানার কথা শুনে শফিক আহমেদ আর কোনো কথা বললেন না। চুপ করে শুয়ে পড়লেন।
শফিকের নিস্তব্ধতায় রাগ উঠে গেলো ফারজানার। চিৎকার করে তিনি আরো তিন চারটি প্রশ্ন করে তার কোনো উত্তর না পেয়ে রাগে গজরাতে গজরাতে শুয়ে পড়লেন।
তারপর, শুয়ে শুয়ে ভাবলেন, এভাবে সংসার করা যায় না। এর একটা হেস্তনেস্ত করতেই হবে।
এসব ভাবতে ভাবতে তিনি তখনই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন, যেভাবেই হোক মাধবীকে এই সংসার থেকে বের করে বাসায় পাঠিয়ে দিতে হবে।
সকালে ঘুম থেকে উঠে শফিক আহমেদ ফারজানার সাথে আর কোনো কথা না বলে চলে গেলেন অফিসে। শফিকের নীরব প্রস্থানে মেজাজ আরো বেশি বিগড়ে গেলো ফারজানার। রাগে গজরাতে গজরাতে তিনি চলে গেলেন মাধবীর কক্ষে। মাধবী তখন বেঘরে ঘুমোচ্ছে।
ফারজানা নিঃশব্দে এগিয়ে গেলেন মাধবীর কাছে। মাধবীর মুখে তখন অপার্থিব এক পবিত্রতা ছেঁয়ে আছে। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি মানুষের মুখে ঘুমের সময় এই রূপ দেখা যায়, যাদের দেখা যায় না, তারা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর মানুষ।
সেই পবিত্র মুখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তিনি সশব্দে চড় বসিয়ে দিলেন মাধবীর গালে। ঘুমের মধ্যে হঠাৎ আঘাত পাওয়ায় ধড়ফড়িয়ে উঠে গেলো মাধবী। চোখ মেলে তাকাতেই দেখলো চাচীর অগ্নিমূর্তি। কিছু বুঝতে না পেরে সে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো চাচীর দিকে।
চাচী তখন বলে উঠলো, হারামজাদি, নিজের বাপের সঙ্গে থাকতে পারিস না? আমার সংসার ভাঙার এতো লোভ কেনো তোর? লজ্জা করে না, নিজের আপন চাচার সাথে এসব করতে?
চাচীর মুখ থেকে এসব কথা শুনে কিছুই বুঝলো না মাধবী। তবে, সে ঠিকই বুঝলো, তার এখান থেকে যাবার সময় হয়ে আসছে। যেই চাচা চাচী ছোটবেলায় সন্তানের অভাবে তাকে নিজের সন্তানের মতো যত্ন করেছেন, তাদের সম্পর্কই এখন তার কারণে ভাঙতে বসেছে।
এসব ভাবতে ভাবতে বেশ কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল চোখে চাচীর দিকে তাকিয়ে রইলো। চাচীর চোখে জল দেখে তার মনে হলো, উঠে বসে চাচীকে কিছু বলতে। কিন্তু, অনেকক্ষণ চেষ্টা করার পরও সে উঠে বসতে পারলো না। প্রচন্ড জ্বরে তার শরীর দূর্বল হয়ে গেছে।
চাচী বেশ কিছুক্ষণ মাধবীর পাশে বসে কান্নাকাটি করে উঠে চলে গেলেন। সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকতেই তার মনে পড়লো, গতরাতে সে জ্বরের ঘোরে আবল তাবল বকছিলো। চাচা সম্ভবত তখন শৌচাগারে যাচ্ছিলেন। তার শব্দ শুনে চাচা তার পাশে এসে বসেন। জ্বর মেপে তাকে ভাত খাইয়ে দিয়ে ঔষধ খাওয়ান। তারপর, তার মাথায় জলপট্টি দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে চলে যান।
ইদানিং চাচা তার কাছে কম আসেন। জিজ্ঞেস করলে বলেন, ব্যস্ত থাকেন। তবে, মাঝেমাঝেই সে দেখে রাতের অন্ধকারে চাচা এসে তার গায়ের চাদর ঠিক করে দেন, না হয় চুপচাপ দাঁড়িয়ে তাকে দেখেন। কিন্তু, তার কারণ সে এতোদিন বের করতে পারেনি। তবে কি চাচী তাকে নিয়ে চাচার সাথে খারাপ কিছু ভাবছেন?
কথাটা মনে উঠতেই মাধবীর গা গোলালো। সে তখনই সিদ্ধান্ত নিলো, এই সংসারে সে আর থাকবে না। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সে তার বাবাকে ফোন করে বললো, বাবা আমাকে নিয়ে যান।
হঠাৎ মেয়ের মুখে এ কথা শুনে বাবা তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কেনো?
তখন মাধবী বলেছিলো, আমি আপনাদের সাথে থাকতে চাই বাবা।
মাধবীর কথার মধ্যে কি যেনো একটা করুণ সুর ছিলো, সেটা বুঝতে পেরে বাবা আর কোনো কথা বাড়াননি।সম্ভবত, পৃথিবীর প্রতিটি পিতাই তার মেয়ের অজানা গোপন কথাটির অর্থ বুঝতে পারেন।
বিকেল হতে হতে তিনি চলে আসেন মাধবীকে নিতে।গায়ে একশ দুই ডিগ্রী জ্বর নিয়ে সেই রাতেই মাধবী চলে যায় বাবার সংসারে।
বাবার সংসারে এসে নতুন করে জীবনের সূচনা করার কথা ছিলো মাধবীর। কিন্তু, সেটা আর হলো না।
সেইরাতে মাধবী চলে আসার পর চাচা-চাচীর প্রচন্ড ঝগড়া হলো। নিজের সন্তান হিসেবে বড় করা একটা মেয়েকে নিয়ে এরকম বাজে মন্তব্য শোনার পরও চুপ ছিলেন শফিক। কিন্তু, এতোটাই খারাপ পরিস্থিতি হলো যে মেয়েটাকে জ্বরের মধ্যে ঘর ছাড়তে হলো- এটা ভাবতেই খুব রেগে গিয়েছিলেন তিনি। তখন, রাগের মাথায় তিনি স্ত্রীকে বলেছিলেন, তোমার সাথে আমি আর সংসার করবো না।
স্বামীর মুখে এই কথা শুনে পড়েছিলেন ফারজানা। তিনি হাউমাউ করে কান্নাকাটি করে সবাইকে গতরাতের ঘটনা বলে দিলেন। ফলাফল, তাদের সংসারে কিছু না হলেও; সবার কাছে চরিত্রহীন হিসেবে পরিচয় পেলো মাধবী।
এই ঘটনার পর মাধবীর জীবন পুরোপুরি বদলে গেলো। বাবা-মা কেউই তাকে আর পছন্দ করতো না। তাকে নিজের মেয়ে বলে পরিচয় দিতে লজ্জা পেতো তারা।
এসময় মাধবীর আত্নহত্যা করাটা হয়তো স্বাভাবিকই ছিলো। কিন্তু, সে আত্নহত্যার বদলে বেছে নিলো বেঁচে থাকা।
সেদিন খুব বৃষ্টি হচ্ছিলো বাহিরে। উচ্চ মাধ্যমিকে ভালো ফলাফল করার পর সে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো আরো পড়াশোনা করবে। সিদ্ধান্ত নিয়ে সে চলে গেলো বাবার কাছে তার সিদ্ধান্ত জানাতে। তার কথা শুনে বাবা বললো, তোমার নিজের তো সম্মান নেই, এবার দয়াকরে আমাদের যেটুকু সম্মান আছে সেটুকু নষ্ট করো না বিশ্ববিদ্যালয়ে যেয়ে নষ্টামি করে। যতো তাড়াতাড়ি পারো এ বাড়ি থেকে বিদায় হয়ে আমায় উদ্ধার করো।
বাবার কথা শুনে মাধবীর খুব মন খারাপ হলো। বাবার সামনে বসেই কিছুক্ষণ কান্নাকাটি করে সে বললো, ঠিক আছে বাবা। আপনি আমার বিয়ের ব্যবস্থা করেন। স্বামীর সংসারে থাকলে তো আপনার সম্মান বেঁচে যায়, আপনি সেটাই করুন। আমি আপনাদের গলার কাঁটা হয়ে থাকতে চাই না।
মাধবীর সম্মতি পেয়েই সবাই তড়িঘড়ি করে নেমে পড়লো বিয়ে দিতে। চারদিকে তখন গোপনে গোপনে পাত্র দেখার ধুম পড়ে গেলো। এরমধ্যে একজন পাত্রকে সবার পছন্দ হয়ে গেলো।
মাধবীকে সেই পাত্রের কথা বলতেই মাধবী বললো, আপনাদের পছন্দ হলেই হলো। আমার আলাদা কোনো পছন্দ নেই।
একমাসের মধ্যে অনেকটা গোপনেই বিয়ে হয়ে গেলো মাধবীর। বিয়ের রাতে প্রথম মাধবী তার স্বামীকে দেখে। আহামরি সুদর্শন কেউ না। গায়ের রং কালো। নিজের উজ্জ্বল রঙের সাথে কোনোভাবেই যায়না তারপরও, মাধবী তা নিয়ে মন খারাপ করলো না।
কিন্তু, লোকটার সাথে খোলামেলাভাবে কথা বলতে গিয়ে মাধবী বুঝতে পারলো, লোকটা প্রচন্ড রকমের ধর্মবিশ্বাসী, পাশাপাশি একটি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের সক্রিয় কর্মী।
ধর্মবিশ্বাস নিয়ে মাধবীর কোনো অসুবিধে না হলেও রাজনৈতিক দর্শন নিয়ে মারাত্নকভাবে সাংঘর্ষিক। ছোটবেলা থেকে গল্প-উপন্যাসে ডুবে থাকার ফলে উদার মনের মানুষ হিসেবে গড়ে উঠা মাধবীর স্বামী সঙ্কীর্ণ মনের অধিকারী। এক্ষেত্রে, উঠতে বসতে, চলাফেরা নিয়ে বিশাল এক দ্বন্দের সম্মুখীন তাকে হতে হবে, ভাবতেই গা শিউরে উঠলো তার। কিন্তু, কিচ্ছু করার নেই। এর সাথেই সংসার করতে হবে।
সবকিছু ভেবে কেমন যেনো অসহায়বোধ করতে লাগলো সে। তখন সে নিজেকে বোঝালো, আগে থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললে কেমনে হবে? আগে কিছুদিন তো একসাথে কাঁটাই তারপর না হয় সবকিছু নিয়ে ভাবা যাবে।
ঠিক সেসময় লোকটা মাধবীকে বললো, তোমার নামে তোমার চাচাকে নিয়ে বেশ কিছু কথা শুনেছি। ঘটনা সত্য কি না জানি না। কিন্তু, আমার মনে হয় না, ঘটনা সত্য। তারপরও, তুমি তোমার সেই চাচার সাথে কোনো যোগাযোগ রাখবা না। কেননা, আমি চাই না, আমার স্ত্রীকে নিয়ে বিয়ের পর কেউ কোনো বাজে কথা বলুক।
লোকটার কথা শুনে মাধবী নিচু স্বরে বললো, আচ্ছা।
তারপর, ঘোমটার আড়ালে নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলো সে। কেননা, যাকে এতোগুলো বছর ধরে বাবা বলেই জেনে এসেছে, তার সাথে সে আর কখনো কথা বলতে পারবে না।
এভাবে নিঃশব্দে কিছুক্ষণ সময় পার করার পর লোকটা কোনো কথা ছাড়াই মাধবীর ঘোমটা তুলে দিলো। ঘোমটা তুলে সে দেখলো, মাধবীর চোখে জল।
সেই চোখের দিকে তাকিয়ে লোকটা বললো, শৌচালয়ে যেয়ে চোখ মুখ ধুয়ে আসো। কান্নাকাটি করা মেয়ে আমার একদম পছন্দ না। আর, তোমাকে আমার কথা মেনে চলতে হবে। কেননা বিধানে বলা আছে, স্ত্রীকে স্বামীর আনুগত্য করতে হবে।
লোকটার কথা শুনে মাধবী চুপচাপ উঠে চলে গেলো শৌচাগারে। তারপর, মুখে পানির ঝাঁপটা দিয়ে আয়নায় নিজেকে দেখে নিজে বললো, জীবন কীভাবে যে বদলে যায় এবার দেখো মাধবী। তুমি শুধু দেখে যাও। দেখো জীবন তোমাকে কোথায় নিয়ে যায়।
(চলবে….)
#পরিবর্তন
#পর্ব_১